ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের বিষয়ে বুধবার রাতে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে গাজায় যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে তিনটি ধাপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। খবর পার্স টুডের।
ইরান ভিত্তিক ওই গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, ১৫ মাস ধরে নৃশংস যুদ্ধ চালিয়েও লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পর এই চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হয়েছে। দখলদার ইসরাইল ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীদের হাতে আটক বন্দিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে নি, হামাসকে নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং গাজা উপত্যকার সামরিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। গাজার রকেট তথা ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি নিশ্চিহ্ন করতে স্থল অভিযানসহ সব ধরণের চেষ্টা চালিয়েছে দখলদার বাহিনী। আল-আলম টিভি চ্যানেলের বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, এই চুক্তিটি তিনটি ধাপে বাস্তবায়িত হবে এবং আগামী ৯ জানুয়ারি রোববার থেকে চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হবে।
এই চুক্তির মূল বিষয়গুলো হলো-
প্রতিরোধ সংগ্রামীদের হাতে আটক সকল ইসরাইলি জীবিত বন্দি মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি মৃত ইসরাইলি বন্দি মুক্তিদের মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। এর বিনিময়ে দখলদার ইসরাইল বহু ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের প্রথম দিন থেকে এই বিনিময় শুরু হবে।
প্রথম ধাপ (৪২ দিন):
যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপটি ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হবে। উভয় পক্ষ হামলা-পাল্টা হামলা বন্ধ রেখে সীমিত পরিসরে বন্দি বিনিময় করবে। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে গাজার জনবসতিপূর্ণ সব এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেবে ইসরায়েল এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যেতে পারবেন। গাজায় পৌঁছানো হবে মানবিক সাহায্য।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের আ-আকসা অভিযানের সময় আটক নারী, শিশু ও পঞ্চাশোর্ধ বেসামরিক নাগরিকসহ ৩৩ জন ইসরাইলি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
হামাস প্রথম দিনে তিনজন ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিককে এবং সপ্তম দিনে আরও চারজনকে মুক্তি দেবে। এরপর হামাস প্রতি সাত দিনে তিনজন ইসরাইলি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যার মধ্যে প্রথমেই নারীরা মুক্তি পাবে। বিনিময়ে, ইসরাইল এই পর্যায়ে আরও বেশি সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যার মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিও রয়েছে। মুক্তির সম্ভাব্য তালিকায় প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি রয়েছেন, যারা সেই ৭ অক্টোবরের পর আটক হয়েছিলেন।
বন্দি বিনিময় চলার মধ্যেই গাজার জনবসতিগুলো থেকে ইসরাইলি বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়া হবে। তবে গাজা সীমান্তের ৭০০ মিটারের মধ্যেই তারা থাকবে।
তবে গাজা ভূখণ্ডের মাঝ দিয়ে যাওয়ার নেতজারিম করিডোর থেকেও পর্যায়ক্রমে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে।
গাজার অবরুদ্ধ উত্তরাঞ্চল থেকে বেসামরিক নাগরিকদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেবে ইসরাইল। সেই সঙ্গে প্রতিদিন ৬০০ ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেবে।
ইসরায়েল আহত ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসার জন্য গাজা উপত্যকা ত্যাগ করার অনুমতি দেবে এবং যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ের বাস্তবায়ন শুরুর সাত দিন পর মিশরের সঙ্গে রাফাহ ক্রসিং খুলে দেবে।
মিশর ও গাজার সীমান্তবর্তী ফিলাডেলফি করিডোর থেকেও পর্যায়ক্রমে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে। আর চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৫০তম দিনের মধ্যে সেখান থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার কর হবে। এই ধাপে গাজা উপত্যকায় দিনে ১০ ঘণ্টা এবং বন্দি বিনিময়ের দিনগুলিতে ১২ ঘণ্টা বিমান চলাচল (সামরিক ও নজরদারি উভয় বিমান) সাময়িকভাবে স্থগিত করা।
দ্বিতীয় ধাপ (৪২ দিন):
প্রথম ধাপের শর্তগুলো পূরণ হলে দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি শুরু হবে। এই ধাপও ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হবে। তবে চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ কার্যকরের বিষয়ে আলোচনাগুলো প্রথম ধাপের ১৬তম দিনের মধ্যে শুরু হবে।
সেখানে অবশিষ্ট সব ইসরাইলি বন্দিকে মুক্তি, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং গাজা থেকে ইসরাইলি বাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এই ধাপে যুদ্ধবিরতিকে স্থায়ী রূপ দেওয়া হবে।
হামাস যদি নিশ্চিত হয় যে, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরুর জন্য সব শর্ত পূরণ করা হয়েছে, তাহলে তাদের হাতে আটক বাকি ইসরাইলিদের তারা মুক্তি দেবে, যাদের বেশিরভাগেই সেনা সদস্য। অন্যদিকে ইসরাইলও তাদের কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেবে।
ইসরাইলের প্রত্যেক মহিলা সেনার মুক্তির বিনিময়ে ইসরাইল ৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। এই ৫০ জনের মধ্যে ৩০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এবং অপর ২০ জন সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত।
তৃতীয় ধাপ (৪২ দিন):
দ্বিতীয় ধাপের শর্ত পূরণ হলে তৃতীয় ধাপে মৃত বন্দিদের দেহ হস্তান্তর করা হবে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীদের হাতে যেসব ইসরাইলি বন্দি ছিল তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জন এরইমধ্যে মারা গেছে। কয়েক জন বন্দিকে খোদ ইসরাইলি বাহিনী হত্যা করেছে। তাদের মরদেহ ফেরত নেবে দখলদার ইসরাইল।
সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে গাজায় তিন থেকে পাঁচ বছরের একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হবে। এর মধ্যে বাসস্থান নির্মাণ, নগর সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠা, বেসামরিক অবকাঠামো এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান অন্যতম। মিশর, কাতার এবং জাতিসংঘসহ কয়েকটি দেশ ও সংস্থার তত্ত্বাবধানে এসব কাজ শুরু হবে। এই ধাপে সীমান্ত ক্রসিংগুলো পুনরায় খুলে দেওয়া হবে এবং মানুষ ও পণ্য পরিবহন সহজতর করা হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। এর ফলে ৪৬ সালের বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ হন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এর হামলায় কমপক্ষে এক লাখ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিভিন্ন মহল থেকে এই কথা স্বীকার করা হয়েছে যে, গাজার বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ১৫ মাসব্যাপী হামলার পরও তারা এই যুদ্ধে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামকে ধ্বংস করা এবং গাজা উপত্যকা থেকে ইহুদিবাদী বন্দিদের ফিরিয়ে আনা। কিন্তু কোনো লক্ষ্যই তারা পূরণ করতে পারে নি।
সূত্র: পার্সটুডে