গাজা দখলের হুশিয়ারি দিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উপস্থিতিতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নতুন পরিকল্পনার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে ১৫ মাস ধরে চলা যুদ্ধে ইসরাইলিদের দ্বারা সৃষ্ট ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের কথা উল্লেখ করে বলেছেন: “গাজা উপত্যকা ফিলিস্তিনিদের জন্য এখন আর উপযুক্ত জায়গা নয় এবং তাদেরকে অবশ্যই ভালো ও নতুন জায়গা দিতে হবে।”
প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও বলেছে, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধান হতে পারে একমাত্র দুই রাষ্ট্র নীতিতে। আন্তর্জাতিক স্তরেই এই নীতির স্বীকৃতি রয়েছে। স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির ধারণাকেই খারিজ করে দিতে চাইছেন ট্রাম্প।
ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলন করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজার কর্তৃত্ব নিয়ে নেবে। গাজার পুনর্গঠন করা হবে।
আমেরিকায় বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞরা সেদেশের সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন বিদেশনীতিতে সেক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনছেন ট্রাম্প।
“আমরা গাজার দখল নেব এবং সেখান থেকে সব বিপজ্জনক অবিস্ফোরিত বোমা ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করার দায়দায়িত্ব নেব। যুক্তরাষ্ট্র বিধ্বস্ত ভবনগুলো ‘সমান’ করবে, সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নকাজ চালাবে, সীমাহীন চাকরির ব্যবস্থা করবে এবং বিশ্ববাসীর জন্য বাড়ি তৈরি করবে।”
ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্ট
গাজায় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় মার্কিন সেনা পাঠানোর সম্ভাবনাও নাকচ করে দেননি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘গাজা সম্পর্কে বলতে হয়, সেখানে যা করার প্রয়োজন, আমরা তা-ই করব। যদি এটির (সেনা পাঠানো) প্রয়োজন হয়, তবে আমরা তা-ও করব।’
গাজা নিয়ে ট্রাম্পের ধারণাকে সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট (ট্রাম্প) গাজা নিয়ে আলাদা রকমের ভবিষ্যৎ দেখেন। আমি মনে করি, এটি এমন কিছু, যা ইতিহাস বদলে দিতে পারে।’
নিজ ভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার যেকোনো চেষ্টাকে জোরালোভাবে নাকচ করে সৌদি আরব এক বিবৃতিতে বলেছে, একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে না।
জর্ডানের তরফ থেকেও ট্রাম্পের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি সাংবাদিকদের বলেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের যেকোনো স্থানচ্যুতির বিরুদ্ধে তাঁর দেশের ‘দৃঢ় ও অটল’ অবস্থানে রয়েছে।
মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একই অবস্থান নিয়েছে। দেশটি বলেছে, ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে স্থানচ্যুতিকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে মিসর। সেটা স্বল্পমেয়াদে হোক, কিংবা দীর্ঘমেয়াদে।
ফিলিস্তিনের পশ্চিমা-সমর্থিত প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মানুষেরা অবিচল থাকবে এবং মাতৃভূমি ত্যাগ করবে না।’ ফিলিস্তিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম ওয়াফা আব্বাসের এই মন্তব্যের একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
গাজা খালি করার বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছেন পাঁচ আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফিলিস্তিনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁরা এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে একটি যৌথ চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিটি সোমবার পাঠানো হয়। চিঠিতে সই করেছেন জর্ডান, মিসর, সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হুসেইন আল-শেখও চিঠিতে সই করেছেন।
চিঠিটি নিয়ে প্রথম খবর প্রকাশ করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস। খবরে বলা হয়, এই কূটনীতিকেরা গত সপ্তাহান্তে মিসরের কায়রোতে মিলিত হয়েছিলেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে দেওয়া যৌথ চিঠিতে বলা হয়েছে, গাজায় পুনর্গঠনের কাজ গাজাবাসীর সরাসরি সম্পৃক্ততা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে হওয়া উচিত। ফিলিস্তিনিরা তাঁদের ভূমিতে বসবাস করবে। তারা গাজা পুনর্গঠনে সহায়তা করবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, গাজা পুনর্গঠনের সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্ব কেড়ে নেওয়া উচিত নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে এই প্রক্রিয়ার স্বত্ব অবশ্যই তাঁদের নিতে হবে।
গাজাকে ফিলিস্তিনিদের ভূমি আখ্যা দিয়ে স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসে ম্যানুয়েল আলবারেস বলেন, অঞ্চলটি ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ, যা স্পেন সমর্থন করে এবং ইসরাইলের নিরাপত্তা ও উন্নতির নিশ্চয়তা দিয়ে গাজা পাশাপাশি অবস্থানে থাকতে হবে।
গাজাবাসীকে নিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেছে চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা আশা করে, সব পক্ষই যুদ্ধবিরতি ও সংঘাত পরবর্তী শাসনকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করবে যাতে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের বিষয়টিকে রাজনৈতিক সমাধানের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা যায়।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, রাশিয়া মনে করে, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মীমাংসা কেবল দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ভিত্তিতেই সম্ভব।
ট্রাম্পের বক্তব্যের সমালোচনা করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সামাজিক মাধ্যমে দেয়া পোস্টে সংস্থাটি বলেছে, গাজা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মন্তব্য বেআইনি ও ভয়ংকর। জোরপূর্বক উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেয়াকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
ট্রাম্পের মন্তব্য নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন হামাসের সিনিয়র নেতা ইজ্জাত এল-রেশিক। তিনি বলেন, ‘গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্বাসন এবং গাজা উপত্যকার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের (ডোনাল্ড ট্রাম্প) বিবৃতিকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।’
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের বিবৃতি ফিলিস্তিন এবং এই অঞ্চল সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও গভীর অজ্ঞতার প্রতিফলন। গাজা অবশ্যই সাধারণ কোনো ভূখণ্ড নয় এবং এটি এমন কোনো সম্পত্তি নয় যা কেনা-বেচা করা যায়। এমন বিবৃতি (ট্রাম্পের মন্তব্য) প্রমাণ করে যে, ইসরাইলের প্রতি এবং আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ও তাদের ন্যায্য অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথার ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ট্রাম্প কেবল গাজার ধ্বংসস্তূপ সরাতে চান। আর তা করতে হলে উপত্যকাটির মানুষদের অন্য জায়গায় সরে যেতে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট কঠোর কোন পদক্ষেপের কথা বোঝাননি বলেও দাবি করেন রুবিও। আর হোয়াইট হাউস বলেছে, গাজা দখলে নেয়ার প্রস্তাবের অংশ হিসেবে উপত্যকায় মার্কিন সেনা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন নি ট্রাম্প।
রুশ দার্শনিক ও চিন্তাবিদ অ্যালেক্সান্ডার ডুগিন মনে করেন বিশ্ব এক-মেরুকেন্দ্রীক ব্যবস্থা থেকে কয়েক-মেরুকেন্দ্রীক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ইরান ও রাশিয়ার মত দেশগুলোকে এই ঐতিহাসিক ক্রান্তি-লগ্নের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।