ইসলাম ধর্মালম্বীদের কাছে রমজান হল সবচেয়ে পবিত্র মাস। ইসলামিক ক্যালেন্ডার অনুসারে, রমজান নবম মাস। রমজান মাসে মুসলমানরা রোজা রাখেন এবং ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকেন। তারা ভোর হওয়ার আগে একবার খাবার খান এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের রোজা চালিয়ে যান। তাদের সংস্কৃতিতে এই রোজার অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্বাস করা হয় যে রোজা তাদের ধৈর্যশীল, বিনয়ী এবং আধ্যাত্মিক হতে শেখায়। রমজান মুসলমানদের জন্য বছরের একটি বিশেষ সময়, যা প্রার্থনা এবং ক্ষমা করার জন্য বরাদ্দ করা হয়। মানুষ রোজার মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করেন এবং সৎকর্ম করে নিজেদের পবিত্র করে তাদের অতীতের সমস্ত পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করেন। রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস। একমাস কঠোর কৃচ্ছসাধন করার পর আসে খুশির ঈদ-উল-ফিতর।
আমাদের ছোটবেলায় মানুষের মধ্যে অন্য ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষের মনোভাব কম ছিল। যার যার ধর্ম সে সে পালন করেছে, তাতে অন্য কেউ বাধা দিয়েছে বলে শুনিনি। এখন সমাজের একাংশের মধ্যে নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে অন্য ধর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার এক কুৎসিত বিকৃত মানসিকতার চাষ চলছে। ফলে ধর্ম নিয়ে উদারতা কমে সংকীর্ণতা বেড়েছে। সাদা চোখে দেখলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে এরই পরিণতিতে উগ্রতা বাড়ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। একটি ছোট্ট উদাহরণ। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হৃদয় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নির্যাতনের খবরে ব্যথিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নির্যাতন হলে, গরু জবাই বন্ধ করার বিধান দেওয়া হলে বাংলাদেশের মুসলিমদের ক্ষুব্ধ হওয়া যৌক্তিক এবং ন্যায্য প্রতিক্রিয়া। ধর্মবিশ্বাসের কারণে কোনও মানুষ বৈষম্যের স্বীকার হলে, নির্যাতিত হলে তার প্রতিবাদ হওয়াই উচিত। সেটা ভারতে হোক, বাংলাদেশে হোক, মায়ানমারে হোক, চীনে হোক, মধ্যপ্রাচ্যে হোক। কিন্তু আমাদের প্রতিক্রিয়া দেশ ভেদে ভিন্ন হয়। আমরা যদি সংখ্যালঘুর বেদনা সত্যই বুঝে থাকি, তাহলে আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি কি আমাদের সেই রকম আচরণ করা উচিত না, যে আচরণ আমরা বাংলাদশের হিন্দুদের জন্য প্রত্যাশা করি? এটা বলা হয়ে থাকে যে, একটা দেশের মানুষ কতটা সভ্য সেটা বোঝার সহজ উপায়- সেই দেশে ক্ষমতাহীনদের প্রতি কেমন আচরণ করা হয় তার মাধ্যমে। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠরা কি সত্যি সত্যি তেমনটা করি ?
পশু কোরবানি দিয়ে মহান সৃষ্টি কর্তার অনুগ্রহ লাভের আশা করা হবে। কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য নিজের অহমিকা ও উচ্চাভিলাষ উৎসর্গ করা। পশু কোরবানির মাধ্যমে মানুষের ভেতরে থাকা পশুশক্তি, কাম-ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতাসহ সব মন্দ রিপুকে ত্যাগ করার শপথ নেওয়ার কথা। প্রশ্ন হলো, মানুষের মনের মধ্যে যে পশুপ্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তার কোরবানি দিতে যদি সমান উৎসাহ দেখানো না যায় তাহলে তো আমরা নিষ্ঠুরতার বদলে মানবিক হয়ে উঠতে পারবো না।
আমাদের পরিবারে-সমাজে পুরনো যে বন্ধন ছিল, যে আন্তরিকতা, মায়ামমতার গিঁট ছিল তা নানা কারণে শিথিল হয়ে পড়েছে। ঈদের দিন আমরা পরস্পর কোলাকুলি করি এখনও ঠিকই, কিন্তু তা যেন কিছুটা কৃত্রিমতায় ভরা। করোনার জন্য মাস্ক পরে যেমন মুখ ঢেকেছি, তেমনি মনের ঔদার্যকে বিশেষ কিছু দিয়ে আড়াল করেই যেন আজকাল আমরা উৎসবে মেতে ওঠার চেষ্টা করি।
আমাদের প্রজন্মের বহু আগে বেগম রোকেয়া, সুফিযা কামাল, ইলা মিত্র, লীলা নাগসহ অনেক নারী আলো হাতে বের হয়েছেন ঘরের ঘেরাটোপ থেকে। তখনও অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের আসলে স্বামীর ঘর করার উপযুক্ত হিসেবেই গড়ে তোলাকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। মেয়েরা একটু লেখাপড়া শিখবে আর বেশি শিখবে ঘরকন্যার কাজ। রান্নাবান্না, সেলাইফোড়াই, ঘর গোছানো, শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন জোগানোর মতো শিক্ষায় মেয়েরা পটু হয়ে উঠুক – এটাই ছিল অধিকাংশ পরিবারের চাওয়া। নারীর কাজ, পুরুষের কাজ বলে কর্মবিভক্তি যে চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা, সেটা মনে করা হতো না। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবার এবং মুসলিম পরিবারে ঘরের ভেতরের অবস্থা প্রায় এক রকমই ছিল। হিন্দু পরিবারে গানবাজনার রেওয়াজ থাকলেও মুসলিম পরিবারে এসব নিয়ে কিছু রক্ষণশীলতা ছিল। তবে আমরা তখন কোনও মুসলিম পরিবারেই হিজাব, বোরকা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। নামাজ-রোজা-কোরান পাঠ ছিল, তবে তা নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখিনি। মসজিদও ছিল সীমিত সংখ্যায়। হিন্দুদের মন্দিরও খুব জাঁকজমক পূর্ণ ছিল না। ধর্মাচরণের দোহায় দিয়ে হিন্দু, মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের একাংশের মানুষ এখন শব্দতাণ্ডবে মেতে উঠছে। মন্দির, মসজিদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। রাজনীতির কারবারিরা ধর্মকে ঢাল করে মানুষের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তুলে ধরছেন।
পবিত্র রমজান মাসে এই বিভেদের প্রাচীর ভেঙে পড়ুক, এই প্রার্থনা করি। রমজান মাসে পাড়ায় পাড়ায় সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা আরও বেশি বেশি করে হোক। পড়শি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় করতে উভয় সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। বেশ কিছু ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে এবং হিন্দু লেখক, কবিদের লেখাও প্রকাশিত হচ্ছে। এটা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক ছবি। বাচ্চাদের জন্য ঈদ সংখ্যা আমার চোখে পড়েনি। আশা রাখি, ছোটদেরও ঈদ সংখ্যায় লিখতে উৎসাহিত করা হবে। আমাদের মতো ধেড়েদের এই দায়িত্ব নিতে হবে। একমাত্র সাংস্কৃতিক চর্চার আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করা সম্প্রদায়ের মধ্যে অজানা অচেনা অনেক কিছু জলের মতো পরিষ্কার হবে এবং একটা সুস্থ সমাজ তৈরি হবে।
আমরা ধর্ম নিয়ে যে উদারতা ও সহনশীলতা দেখে বড় হয়েছি, এখন আর তা দেখি না। তখন মানুষের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার কম ছিল, কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক ‘সহবত’ ছিল বেশি। তখন নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি ছিল আলাদা। এক পরিবারের অভিভাবক, অন্য পরিবারের ভালোমন্দ নিয়ে উদাসীন থাকতেন না। আমার প্রতি আমার বাবা যেমন নজর রাখতেন, আমার বন্ধুর প্রতিও রাখতেন। কারও বাবা নিজ সন্তানের সঙ্গে অন্যের সন্তানকেও শাসন করার অধিকার রাখতেন। পরিবারে বা ব্যক্তি পর্যায়ে হিংসা-বিদ্বেষ ছিলনা, তা নয়। তবে সেটা কখনও সামাজিক স্থিতি বিনষ্টের কারণ হয়নি।
সময় বদলেছে। বদলেছে রুচি। বদল এসেছে জীবনযাপনে। গতিময় জীবনে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগকে। প্রাণের স্পন্দন হারিয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক জীবনযাত্রায়। যন্ত্র সভ্যতা মানুষের মধ্যেও পরিবর্তন এনেছে। জটিলতা বেড়েছে। ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের আড়ম্বর বাড়ছে। আন্তরিকতা কমছে। মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পরিবর্তনের সঙ্গে না চলে উপায় নেই। কিন্তু পরিবর্তনটা যেন কিছুতেই মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি না করে। মানুষ হোক মানুষের জন্য। এবার পবিত্র রমজান মাসে আমাদের সবার প্রার্থনা হোক –আর্ত ও দুস্থ মানুষের প্রতি যেন আমরা অবহেলার মনোভাব পরিহার করি। যুদ্ধ ও হিংসা-হানাহানির অবসান ঘটুক। সব মানুষের জীবন নিরাপদ হোক। পবিত্র রমজান মাস সবার জন্য শান্তি বয়ে আনুক। সম্প্রীতির উদাহরণ হয়ে থাক রমজান মাস।