যেহেতু বয়সের দিক থেকে আমি অর্ধ শতক পেরিয়ে গিয়েছি, তাই ঈদ নিয়ে খুব পুরোনো স্মৃতি বলতে মনে পড়ে, ছোটবেলায় আজহারউদ্দিন ভারতকে ক্রিকেট ম্যাচ জিতিয়েছেন, আর সেই আনন্দে কোনও পরিবারের কোনও মুসলিম বন্ধু ঈদের দিন নেমন্তন্ন করেছেন। সেই নেমন্তন্নে অবশ্যই বিরিয়ানি, সিমুই তো থাকতই, তার সঙ্গে থাকত লাচ্ছা পরোটা আর মাংসের কোনও পদ। ছোটবেলা থেকেই মাংস খেতে যেহেতু আমার একটু অনীহা ছিল, পারিবারিকভাবে যাঁরা আমায় চিনতেন, তাঁরা এর সঙ্গে মাছেরও কোনও পদ রাখতেন।
এটা যদি ঈদের নেমন্তন্ন নিয়ে আমার প্রাথমিক স্মৃতি হয়, তাহলে বলব পরের ৩০ বছর ধরে জীবনে নানা স্মরণীয় ইদ কাটিয়েছি। কখনও বন্ধুদের বাড়িতে নেমন্তন্নে, কখনও বাংলাদেশে ঢাকায়, আবার কখনও মালদ্বীপে। এই উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শহরে ইদ এবং রমজানের মাস কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। মালদ্বীপে গোটা রমজানের মাসে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় চমৎকার ইফতারি বিক্রি হতো। রোজা ভঙ্গের পর স্থানীয় মানুষ সেইসব রেস্তোরাঁয় ইফতারি খেতে যেতেন। আমিও দলে পড়ে বা কখনও পরিচিতদের আমন্ত্রণে সমুদ্রের ধারে অসাধারণ সব রেস্তোরাঁয় ইফতারি খেয়েছি। মালদ্বীপে সমুদ্রের ধারের রেস্তোরায় বসে শরবতে চুমুক দিয়ে ইফতার শুরু করার পেলব স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে এবং হৃদয়ে টাটকা। সেই স্মৃতি চট করে ভুলে যাব না। যেমনই ভুলে যাওয়ার নয়, যে ঈদের দিনে ঢাকা এয়ারপোর্টের সাজসজ্জার কথা। ঈদের দিন ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরছি, যেমন সেজেছেন বিমানবন্দরের কর্মীরা, তেমনই সেজে উঠেছে বিমানবন্দর। সেই স্মৃতিও তো মানসপটে চমৎকারভাবে রয়ে গিয়েছে।
রমজানের মাস এবং রোজা, এই গোটা একটি মাস ধরে মুসলিমরা যেভাবে সংযম এবং কৃচ্ছ্রসাধন করেন, তা এতটাই আমাকে আকর্ষণ করেছিল, যে আমি পরপর দুবছর নিজে রোজা রেখেছিলাম ! হ্যাঁ, অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও রেখেছিলাম।
আমার মনে হয়েছিল, যে রোজা রাখলে শরীরে যেসব রোগ রয়েছে, সেগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং একটা সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে অন্তত এক মাস যাওয়া যাবে। ওই দুটো বছরও আমার জীবনে খুব স্মরণীয়। পরবর্তীকালে অবশ্য আমার বয়স বেড়েছে, হাজারও কাজের মাঝে আর অত শৃঙ্খলার সঙ্গে রোজা রাখার সাহস পাই না। কিন্তু যাঁরা রোজা রাখেন, এই একমাস ধরে যাঁরা কৃচ্ছ্রসাধন করেন, তাঁদের কৃচ্ছ্র এবং সংযমকে আমি সবসময়ই কুর্নিশ জানাই। আমার অফিসে যেহেতু অনেক মুসলিম কাজ করতেন এবং এখনও করেন, তাই মাঝেমধ্যেই সন্ধেবেলায় নির্দিষ্ট সময়ে ইফতারের আয়োজন হয়। শরবৎ, ছোলা ভুনা, বিভিন্ন ধরনের ভাজাভুজি, ফল— এই দিয়ে ইফতার আমার গত বিশ বছরের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে গিয়েছে। এই ইফতারের পাশাপাশি ঈদ এলেই এখন আলাদা একটা উত্তেজনা থাকে, ওইদিন বাড়িতে কি স্পেশাল রান্না হবে?
যেহেতু আমাকে একজন মুসলিম মহিলার সঙ্গেই জীবন কাটাতে হয়, তাই ঈদ মানেই আমার জন্য একটা স্পেশাল বিষয়। ঈদের দিন কীভাবে কী কী ধরনের বিরিয়ানি রান্না হবে, কী রান্না করবেন আমাদের অন্যতম প্রিয় মানুষ সুফিয়া দি, কী ধরনের সিমুই রান্না হবে— এই সব নিয়ে আমরা অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে থাকি। ঈদের দিন সকালবেলা শ্বেতশুভ্র পোশাকে যখন মুসলিমদের নামাজ থেকে ফিরতে দেখি, তখন নিজের মনেও একটা শ্রদ্ধার ভাব আসে। আমি কোনওদিনই খুব একটা ধার্মিক নই। নিজের ধর্ম হিন্দু ধর্মকেও খুব একটা অনুসরণ করেছি এমনটা গর্বের সঙ্গে বলতে পারব না। কিন্তু যাঁরা ধর্মকে নিজেদের হৃদয়ে, নিজেদের জীবনযাপনের সঙ্গে উদযাপন করেন, তাঁদের দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা আনত হয়। এবং ওই যে বললাম, এই একমাস কৃচ্ছ্রসাধন ও সংযমের করে তারপরে যে উদযাপন, খুব আগ্রহ ভরে সেটার জন্যও অপেক্ষায় থাকি। রমজানের মাসে মুসলিমদের যে ত্যাগ, সংযমের দীক্ষা হয়, তারপরে একমাসের কৃচ্ছ্রসাধনের পরে যখন উদযাপনের সময় আসে, তখন সত্যিই সেটা মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়।