ফাল্গুনের মৃদুমন্দ বাতাসে যখন প্রকৃতি নবজীবন লাভ করে, ঠিক তখনই এলো রমাদান- ইবাদতের বসন্ত। এটি কেবল সংযমের মাস নয়, বরং আত্মশুদ্ধির, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের এবং আত্মাকে পাপমুক্ত করার অপূর্ব এক সুযোগ। রোদের তীব্রতা যেমন বসন্তের কোমল স্পর্শে প্রশান্ত হয়, তেমনি রমাদানের সিয়াম, কিয়াম ও দোয়ার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ হয়, আলোকিত হয় তাকওয়ার নূরে। এ মাসই সেই স্বর্ণসময়, যখন আল্লাহর রহমতের দরজা উন্মুক্ত হয়, পাপ মোচনের সুযোগ মেলে, আর আত্মা ফিরে পায় তার প্রকৃত সৌন্দর্য।
রমজান মুসলমানদের জন্য এক মহান বরকতময় মাস। এটি আত্মশুদ্ধি, সংযম এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ সময়। এ মাসে মুসলিম উম্মাহ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখে, যার মাধ্যমে তারা তাকওয়া অর্জনের চেষ্টা করে।
কুরআনে বলা হয়েছে,
“হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের (রোজার) বিধান দেওয়া হলো, যেমন সিয়ামের বিধান তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সুরা বাকারা: ১৮৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (বুখারি-৩৮)
রমজানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—এই মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে, শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত
রোজা কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করার নাম নয়, বরং এটি আত্মসংযমের অনুশীলন। রোজা মানুষের ঈমানকে শক্তিশালী করে এবং তাকওয়া বৃদ্ধি করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের ঘ্রাণের চেয়েও সুগন্ধময়।” (বুখারি-১৮৯৪)
রাত্রি জাগরণ ও তারাবিহ নামাজ
রমজানে রাতে ইবাদত করা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রাতে ইবাদত করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।” (বুখারি-২০০৮)
রমজানের রাতে তারাবিহ নামাজ পড়া সুন্নত। এটি কিয়ামুল লাইলের (রাত্রি জাগরণ) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাহাবিরা তারাবিহ নামাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তা জামাতে আদায় করতেন।
লাইলাতুল কদর: হাজার মাসের চেয়েও উত্তম
রমজানের শেষ দশ দিনের এক বিশেষ রাত হলো লাইলাতুল কদর।
আল্লাহ বলেন,
“লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) নেমে আসেন, তাদের রবের নির্দেশক্রমে সব বিষয়ে। শান্তি বিরাজ করে ফজরের طلوع পর্যন্ত।” (সুরা কদর: ৩-৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় ইবাদত করবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (বুখারি-২০১৪)
এই রাতে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ, তাওবা-ইস্তিগফার ও দোয়া করা উচিত।
ইতিকাফ: আত্মশুদ্ধির অনন্য ইবাদত
রমজানের শেষ দশ দিনে ইতিকাফ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। ইতিকাফের মাধ্যমে একজন মুমিন নিজেকে দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে দূরে রেখে পুরোপুরি ইবাদতে নিমগ্ন হতে পারে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি বছর রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে ইতিকাফ করতেন।
ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্য:
দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে সরে এসে একাগ্রচিত্তে ইবাদত করা
লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভের চেষ্টা করা
আত্মশুদ্ধি অর্জন করা
নারীরাও নির্দিষ্টভাবে ঘরে ইতিকাফ করতে পারেন।
ফিতরা: রোজার পরিপূর্ণতা
ফিতরা হলো রমজানের শেষে গরিবদের সাহায্য করার জন্য বাধ্যতামূলক একটি দান।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন, যাতে রোজাদারের জন্য এটি পবিত্রতা হয় এবং গরিবদের জন্য খাদ্যের সংস্থান হয়।” (আবু দাউদ-১৬০৯)
ঈদের আগেই ফিতরা আদায় করা উত্তম, যাতে গরিবরা ঈদের দিন আনন্দ করতে পারে।
রমজানের অন্যান্য করণীয়
১. কুরআন তিলাওয়াত: কুরআন এই মাসেই নাজিল হয়েছে, তাই বেশি বেশি তিলাওয়াত করা উচিত।
২. তারাবিহ নামাজ: সুন্নত নামাজ, যা রমজানের বিশেষ ইবাদত।
৩. সদকা ও দান: দান-খয়রাতের জন্য রমজান সর্বোত্তম মাস।
৪. তাওবা ও ইস্তিগফার: গুনাহ মাফের মাস হওয়ায় বেশি বেশি ক্ষমা চাইতে হবে।
৫. রোজা ভঙ্গের পর দোয়া: ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয়।
রমজান মাস ইবাদতের বসন্তকাল। এটি জান্নাত লাভের শ্রেষ্ঠ সময়। আমরা যেন এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাই, বেশি বেশি ইবাদত করি, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের ফজিলত লাভের তৌফিক দান করুন, আমিন!