বিশ্ব শান্তি মানবসভ্যতার একটি অনন্ত প্রত্যাশা, কিন্তু যুদ্ধ, সংঘাত, ও বৈষম্যের শিকড় অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রোথিত। সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জাতীয়তাবাদ, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, এবং আধুনিক যুদ্ধের বাণিজ্যিকীকরণ—এসবই অশান্তির জন্ম দিয়েছে। এছাড়াও, গাজা উপত্যকার মতো সমকালীন সংকটগুলি বিশ্বশান্তির পথে বড় বাধা। এই নিবন্ধে অতীত ও বর্তমানের অশান্তির দার্শনিক উৎস, ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক ব্যক্তিত্বদের ভূমিকা, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য কৌশলগুলিকে একত্রে বিশ্লেষণ করা হবে।
অশান্তির দার্শনিক ও ঐতিহাসিক কারণ:
- সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ:
ইউরোপীয় শক্তিগুলির “সিভিলাইজিং মিশন” এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় রক্তক্ষয়ী শোষণের জন্ম দিয়েছে। ব্রিটিশ ও ফরাসি উপনিবেশগুলি স্থানীয় সংস্কৃতি ও সম্পদ ধ্বংস করে বৈশ্বিক বৈষম্যের ভিত্তি তৈরি করেছে। যার ফল এখনো বিশ্ব বাসী প্রতিনিয়তই ভুকছে। হর্বার্ট স্পেন সারের দার্শনিক ভিত্তি “সামাজিক ডারউইনবাদ”, যা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকে ন্যায্যতা দিয়েছে। এই জন্যই আজ বহু দেশে অশান্তি বিরাজ করছে। - ধর্মীয় মৌলবাদ ও অসহিষ্ণুতা:
ক্রুসেড, জিহাদি গোষ্ঠী (আল-কায়েদা, আইএস), এবং সংখ্যালঘু নিপীড়ন ধর্মকে হাতিয়ার করে সংঘাত তৈরি করেছে। এই সংঘাত প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দার্শনিক ভিত্তি: “অন্যকে শত্রু” হিসেবে চিহ্নিত করার রাজনৈতিক দর্শন। রাজ নেতারা নানা ভাবে নানা কৌশলে আনয়ন করে নিজের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে দেশ ও বিশ্বকে অশান্ত করে তুলেছে। - জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদ:
নাৎসি জার্মানি ও ফ্যাসিস্ট ইতালি জাতিগত বিশুদ্ধতার নামে গণহত্যা চালিয়েছে। বর্তমানে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদ সংঘাতকে প্রজ্বালিত করছে। একইভাবে গাজার অধিবাসীদের দীর্ঘদিন বন্দী দশায় রেখে মানবিক সংকট তৈরি করা হয়েছে। - সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ:
শীতল যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শিক দ্বন্দ্ব বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের কিনারায় নিয়ে গিয়েছিল। পুঁজিবাদী বৈষম্য ও সমাজতান্ত্রিক স্বৈরাচার উভয়ই অশান্তির কারণ। এর থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ না খুঁজে তাকেই অবলম্বন করে দিকভ্রান্ত পথে চলেছে বিশ্ব। এই পথে শান্তি নেই। এতে শুধু আছে বিড়ম্বনা। - আধুনিক যুদ্ধের বাণিজ্যিকীকরণ:
যদি দেখি ইরাক যুদ্ধ (২০০৩) তেলের নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সংঘটিত হয়েছিল। প্রচার ও ইস্যু বাস্তবের সঙ্গে সংগতি ছিলনা। - উপনিবেশিক উত্তরাধিকার ও গাজা সংকট:
ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে গাজা উপত্যকার মানবিক বিপর্যয়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল, ১৯৬৭ সালের সামরিক দখল, এবং গাজায় চলমান অবরোধ ২৩ লক্ষ মানুষকে মানবেতর জীবনে বাধ্য করেছে। 8এর মূল কারন হল, দার্শনিক ভিত্তি। তা হল, ইহুদি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ (জায়নিবাদ) ও ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের আদর্শিক সংঘাত। এই সংঘাত বন্ধ করার জন্য বিশ্ব নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিশ্ব অশান্তির জন্য দায়ী ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব:
ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব: চেঙ্গিস খান, অ্যাডলফ হিটলার, জোসেফ স্টালিন এদের কারনে মানবতার মৃত্যু ঘটেছে। ফলাফল শূন্য থেকেছে। এদের মধ্যে সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব গুলি হল, জর্জ ডব্লিউ. বুশ (ইরাক যুদ্ধ), ওসামা বিন লাদেন (সন্ত্রাসবাদ), বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু (গাজায় সামরিক নীতি), এক তরফাভাবে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব দরবারে এমন কেউ নেই, যে তার হাত শক্ত করে ধরে বলবে। তুমি যা করছ তা অন্যায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে উদ্দেশ্যে বিশ্ব শান্তির আশায় জাতি সংঘ নির্মাণ করে ছিল সেখানে নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো রাজনীতি ও নিষ্ক্রিয়তা আজ বিশ্বকে বিপন্ন করেছে। এই ভেটো শক্তি বলে বহু রাষ্ট্র তার ন্যায় থেকে বঞ্চিত হয়।
বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য পথ:
- মানবতাবাদী দর্শন ও শিক্ষার প্রসার:
ইমানুয়েল কান্টের “চিরশান্তি” তত্ত্ব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। জাতি, ধর্ম, ও লিঙ্গভিত্তিক বিভেদ দূর করতে শিক্ষাক্রমে বহুত্ববাদী মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করা। যা এক বিশ্ব নাগরিকের মানসিকতার পরিচয় বহন করবে। - ধর্মনিরপেক্ষ সংলাপ ও সহাবস্থান:
পোপ ফ্রান্সিসের আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মডেল অনুসরণ। ভারত ও বাংলাদেশের মতো বহুসংস্কৃতির দেশে জাতীয় সংহতি জোরদার করা। তা নাহলে দেশ পেছনের দিকে ধাবিত হবে। - অহিংস আন্দোলন ও যুবশক্তির উদ্যোগ:
গান্ধীর সত্যাগ্রহ ও মার্টিন লুথার কিংয়ের আদর্শে ফিলিস্তিনে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ (গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন) সমর্থন। মালালা ইউসুফ জাইয়ের মতো যুব নেতৃত্বকে ও বিশ্ব শান্তির জন্য যারা ভাবিত তাদেরকে সম্পৃক্ত করা একান্তভাবে জরুরি হয়েছে। - অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও টেকসই উন্নয়ন:
জাতিসংঘের SDGs বাস্তবায়নের মাধ্যমে বৈশ্বিক সম্পদের সুষম বণ্টন। গাজায় অবরোধ প্রত্যাহার ও UNRWA-কে অর্থায়ন বৃদ্ধি করে দ্রুত মানবিক সহায়তা পাঠানোর ব্যবস্থা করা আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করতে হবে। - আন্তর্জাতিক আইন ও দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান:
গাজা সংকট সমাধানে ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ICC-তে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে মান্যতা দিতে হবে। তানাহলে বিশ্ব নেতৃত্ব লাগাম ছাড়া হয়ে পড়বে। - পরিবেশ শান্তি ও নারী ক্ষমতায়ন:
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সবুজ শক্তি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ। গবেষণামতে, নারী নেতৃত্ব সংঘাত হ্রাস করে—ফিলিস্তিনি নারীদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্ব বাসী নীরব দৃষ্টিতে না তাকিয়ে একটি স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। - আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতা:
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মডেলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি জোট গঠন। যে জোট মিলিত ভাবে নিজেদের সমস্যা গুলিকে চিহ্নিত করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা। তার সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ব্যবস্থা সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, বিশ্ব শান্তি কোনো স্বপ্ন নয়, বরং একটি অর্জনযোগ্য লক্ষ্য। অতীতের রক্তাক্ত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবতা, ন্যায়বিচার, ও সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে। গাজা ও ইউক্রেন সহ একাধিক দেশে সংকটের সমাধান ছাড়া এই লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব—যেখানে শিশুরা শিক্ষা ও নিরাপত্তার অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেখানে বিশ্বশান্তি অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “মহামানবের সাগরতীরে” এক হয়ে বিশ্ব শান্তির পথ খুঁজতে হবে। সকল সংঘাতের ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক ঐক্যেই নিহিত রয়েছে শান্তির চাবিকাঠি।