ইসমাইল দরবেশ, টিডিএন বাংলা:
আমার কাছে একজন পাঠক জানতে চেয়েছিলেন — ‘আপনার গল্প, উপন্যাস বা অন্যান্য লেখায় আরবি শব্দ, ইসলামি বিষয়াদি বেশিবেশি উঠে আসার কারণ কী?’ যেহেতু তিনি অমুসলিম পাঠক, তাই তাকে সবিনয়ে উত্তর দিয়েছিলাম — ‘এটা স্বাভাবিক বিষয় নয় কি? একজন অমুসলিম লেখকের কলমে সন্ধ্যার বর্ণনায় তুলসীতলা আর শঙ্খধ্বণি উঠে আসা যেমন স্বাভাবিক, তেমন মুসলিম লেখকের কলমে মাগরিবের সময়ের বর্ণনায় আজানধ্বণি বর্ণিত হওয়াটাও স্বাভাবিক। কাজেই আমি যখন একজন গদ্য লেখক; তখন সেই সব অনুষঙ্গ আমার লেখাতে উঠে আসবেই, সেটা সচেতনভাবে হোক বা অবচেতনে’।
তখন তিনি প্রশ্ন করলেন — ‘আপনি কি নিজেকে একজন মুসলিম লেখক হিসেবে বিবেচনা করেন?’ আমি তাঁকে বললাম — ‘আপনার প্রশ্নটাই আমার কাছে সঠিক বলে মনে হল না। লেখকদের আলাদা করে হিন্দু-মুসলমান হতে হয় না; তবে লেখকের ব্যাক্তিসত্বা যে সমাজে বিকশিত হয়েছে, তাকে এড়িয়ে চলবে কি করে একজন মানুষ? বাল্যকাল থেকে দেখে আসা দৃশ্য, কানে শোনা শব্দ, উপলব্ধ হওয়া আচার থেকে নিজেকে কখনও আলাদা করা যায়? আমাদের যাপিত জীবনের অংশ হয়ে তারা থেকে যায়। যাদের লেখায় থাকে না; তারা আসলে সচেতনভাবেই রাখে না। সে কথা ভিন্ন। আমাদের উৎসব-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি — সবকিছুর মধ্যেই ধর্মীয় অনুসঙ্গ থাকে। তা সেটা কি কেবল মুসলমানদের ক্ষেত্রেই? যে কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যেই তো সেটা থাকে। আমি একজন মুসলমান, স্বাভাবিক কারণেই ইসলামি বিষয়াদি থাকে।’
এমনিতেই মুসলমান সমাজে উৎসব অনুষ্ঠান কম। যাবতীয় উৎসব মূলত নামাজকেন্দ্রিক। বাকি যেগুলি উৎসব হিসেবে পালিত হয়, তা কিন্তু পুরোপুরি ইসলামিক নয়। দেশ ও কালের আবর্তে হয়তো কিছু কিছু উৎসব-অনুষ্ঠান ইসলামিকরণ করা হয়েছে, তবু তার মধ্যেও থেকে গেছে ইসলামি ভাবধারা এটা অনস্বীকার্য। মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব অবশ্যই ঈদ। ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ এবং ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ। এর মধ্যে রোজার ঈদ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। এক মাস যাবৎ রোজা-সাধনার পরের দিনই ঈদ। ঈদের আগের রাতটাকে ডাকা হয় চাঁদরাত। এই চাঁদরাত ও ঈদের স্মৃতিময়তায় আচ্ছাদিত হয়ে থাকে মুসলমান মন। সত্যি বলতে কি; এই ঈদের অপেক্ষা থাকে সেই শবেবরাত থেকে। সপ্তাহ দুয়েক পরেই শুরু হয় রমজান মাস। আর রমজান মানেই সারাটা মাস আনন্দমুখর। রমজানের সেহেরি সময় আমার কাছে বেশ নস্টালজিক। সেহেরি মানে শেষ রাতের আহার। ফজরের আগে এই খাবার খেতে হয়, রোজা বা সিয়াম পালনের উদ্দেশ্যে। আমার ছোটবেলার কয়েকটি স্মৃতিচারণ করি। এখনও প্রতি সেহেরিতে আমি ফিরে যাই সেই বাল্যকালে, ফিরে যাই তারুণ্যের তেজদীপ্ত তাসাল্লিতে।
সেই কবেকার কথা! আমাদের বাড়িতে রেডিও ছিল না। বাড়ির পিছনে বড় কবরস্থানের অবস্থান। জঙ্গলময় কবরস্থানের ওপারে শুকুর চাচার বাড়ি। তাদের ইয়াবড় কাঠের রেডিও থেকে সেহরির আগে ভেসে আসত হামদ ও নাত। রেডিও বাংলাদেশ। সেই সুর আমার কানে আজও বাজে। তখন জানতাম না এগুলি কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ইসলামি সংগীত। ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’, ‘তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার মুহম্মদের নাম’ কিংবা ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’। এইসব সংগীতের একটি মায়াময় আবেদন ছিল। তন্ময় হয়ে শুনতাম। শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল কতক গান। সব শেষে বাংলাদেশের সেই বিখ্যাত আজান ও দোয়া।
পাড়ার যুবকদের ছিল সেহেরি কমিটি। একদল যুবক কোরাস কণ্ঠে নাতে রসুল ও নাসিদ গেয়েগেয়ে রোজাদারদের জাগানোর দায়িত্ব নিত। মাঝে মাঝে নারায়ে তকবীর, আল্লাহ আকবর ধ্বণিত হত। আমার বালক মন ছটপট করত এই দলটিকে দেখার জন্য। বেরিয়ে আসতাম ঘর ছেড়ে। হ্যাজাকের আলো ধরে এগিয়ে যাওয়া সেই গজল দলকে দেখে মোহিত হয়ে উঠতাম। যতক্ষণ না পাড়ার মোড়ে অদৃশ্য হচ্ছে তারা, চেয়ে থাকতাম। তরুণ বয়সে সেই গজল দলের নেতৃত্ব একসময় আসে আমারও হাতে। নিজেই লিখতাম গজল। সুর দিয়ে গাইতাম আমরা দলের সকলেই। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। নির্মম সময়ের বাস্তবতায় সে সব হারিয়ে গেছে। কিন্তু আজও প্রতিদিন সেহেরিতে উঠে ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করি সেই উদাত্ত কণ্ঠে ভেসে আসা নজরুল ইসলামের সংগীতের সুর। সেই কোরাস কণ্ঠের গজল। প্রতিদিন ব্যর্থ হই। সেই কম্পমান বাতাসের সাথে ভেসে আসা চড়াই-উৎরাই তরঙ্গায়িত সুর মূর্চ্ছনা শোনার জন্য মুখিয়ে থাকে কান। আর শোনা যায় না। হারিয়ে যাওয়া এই স্মৃতি আমাকে নস্টালজিক করে তোলে।
পঁচিশটা রোজার পর ‘আলবিদা’ বিষয়ক গজল গাওয়া হত সে সময়। ‘মাহে রমজান, মাহে রমজান/ আসসালামু আসসালাম। কূল মোমিনের নাও গো তসলিম/ আসসালামু আসসালাম’। বিদায়ী গজলে সকলের কণ্ঠে থাকত বিষাদময়তা। শেষ সেহেরির দিন দুঃখভারাক্রান্ত বিরহ গজলে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠত দল ও শ্রোতাদের। ‘বড়ই পেয়ারা রহমতের মাস হায় আজ চলে যায়, বলো আলবিদা ভাই’।
রমজানের সেহেরি, রোজা, ইফতার, তারাবি — আমার ইবাদত, বিশ্বাস, আমার সংস্কৃতি।
ইফতার, একজন রোজাদারের কাছে স্বর্গীয় অনুভূতি। আমরা এখনও একান্নবর্তী পরিবার। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আসরের পর ইফতারির আয়োজনে ব্যস্ত আমাদের বাড়ির নারীরা। কি অসাধারণ তাদের সহিষ্ণুতা! সারি সারি প্লেটে সাজানো ফলমূল, সরবৎ, তেলেভাজা, ঘুগনি থেকে শুরু করে যাবতীয় মুখরোচক খাদ্য সামনে নিয়ে বসে থাকা। আমরা ছোটরা কান খাড়া করে অপেক্ষা করছি; কখন মোয়াজ্জিনের আজান শুনব। আমার আব্বা সকলকে নিয়ে এই সময় হাত তুলে মোনাজাত করেন। এখনও বহাল আছে এই নিয়ম। আমরা আমিন আমিন করতাম। এক সময় আজান কানে ভেসে আসত। তখন যে কী আনন্দ; তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ইফতার, মগরিবের নামাজ শেষে দেড় দুঘন্টা পরেই শুরু হবে তারাবি। মসজিদেই যেতাম। কখনও কখনও বাড়িতেও জামাত করে আমরা ভাইভাইয়ে তারাবি পড়তাম। দীর্ঘ নামাজের পর একটু ক্লান্তি আসে। সেই ক্লান্তির পর কিছু সামান্য খেয়ে শোয়া মাত্রই ঘুম। প্রশান্তির ঘুম। তাই প্রতি বছর রমজানের যত দিন ফুরিয়ে আসতে থাকে, একটা বিরহ বেদনা চেপে বসে।
একদিকে আগত ঈদের আনন্দ, অন্যদিকে রমজানের বিদায়-বিষণ্ণতা দুই অনুভূতি মনের মধ্যে অন্যরকম উপলব্ধি তৈরি হয়। কাজেই সেই সব অনুভূতি আমার লেখাতে শব্দ ও বাক্য হয়ে প্রকাশিত হয়ে ওঠে। টিডিএন বাংলার অনুরোধে এই যে স্মৃতিময়তার প্রকাশ, এটিও আসলে রমজানের প্রতি প্রবল আবেগের বহিঃপ্রকাশ। জানি না আর কয়টা রমজান মাস পাবো; যে কটাদিন পাবো, তা যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি; আল্লাহর কাছে এই আমার আর্জি।
(লেখক: উপন্যাসিক)