হামিদুল ইসলাম সেখ
সালটা ঠিক মনে নেই, তবে স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের রোজার দিনগুলোর কথা। আজকের মতো তখনকার দিনগুলো ডিজিটাল ছিল না, ছিল একদম সাদামাটা, কিন্তু আনন্দ ছিল ষোল আনা। রমজান মাস আসার আগেই পুরো গ্রামজুড়ে রোজার এক অদ্ভুত আবহ ভেসে আসত। শবে বরাতের রাত পেরোলেই আমরা, ছোটরা, রোজার আগমনের দিন গুনতে শুরু করতাম। সারা পাড়ায় তখন হালুয়া-রুটির ঘ্রাণে মন ভরে যেত। কী যে আনন্দ ছিল! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই দিনগুলো বড়ই মিস করি…
শৈশবে পুরো এক মাস রোজা রাখা সম্ভব হতো না, তবে প্রথম ও শেষ রোজার মধ্য দিয়ে সেই আনন্দটুকু যেন ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। যেদিন রোজা রাখতাম, সেদিন সকাল থেকেই মনে হতো—আর কতক্ষণ বাকি ইফতারের! বিকেল হলেই আমরা সমবয়সী ছেলেরা হাতে হেঁসুয়া নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম দাঁতন কাটতে। মুঠো ভর্তি দাঁতন নিয়ে পাড়ার রোজাদারদের মাঝে বিতরণ করতাম। দাঁতন দিতে পারলে এক অদ্ভুত আনন্দ হতো, মনে হতো যেন নেকি লাভের এক বিশাল সুযোগ পেয়েছি।
আমাদের বাড়ির সামনে ছিল জুম্মা মসজিদ, আর রোজার সময় প্রতিদিন ঘন্টার শব্দ শোনার অপেক্ষায় থাকতাম। গ্রামের সবচেয়ে লম্বা মানুষটি সেই ঘন্টা বাজানোর দায়িত্বে ছিলেন। আমরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কবে তিনি সেই কাঠের হাতুড়ি দিয়ে কাঁসার বড় চাঁদের মতো ঘন্টার পিঠে আঘাত করবেন। সেই মুহূর্তেই দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে মাকে বলতাম, “মা, মা, ইফতার করো… ঘন্টা পড়েছে!” মা ততক্ষণে ইফতারি সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন, আর আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার করতাম।
যেদিন রোজা রাখতাম, সেই দিনগুলো ছিল আরও বিশেষ। সেহেরির সময় থেকে শুরু হতো সাবধানতা—কোনোভাবে যেন ঢোক গিলে না ফেলি! সকাল থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত থুতু ফেলতে ফেলতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। দুপুরের পর থেকে পেটের ওপর ভেজা গামছা রেখে একটু স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করতাম। মনে হতো, গলার শ্বাসনালী যেন ফেটে যাচ্ছে! সে এক কষ্টভরা আনন্দ!
আজকের এই ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে সেই অনুভূতিগুলো বোঝানো কঠিন। এখন তো রোজা আসে, আবার চলেও যায়—শৈশবের সেই এক মাসব্যাপী আনন্দ আর খুঁজে পাই না।
বর্তমান শৈশব কৃত্রিম আনন্দে ভেসে যাচ্ছে। আমাদের সময় ছিল দলগত আনন্দ, ছিল পারস্পরিক ভালোবাসা। আমরা গ্রামে বড় হয়েছি, তাই গ্রামের সেই শৈশবের আনন্দ আজও হৃদয় ছুঁয়ে যায় রমজান এলেই। এখনো খুঁজি আমার শৈশব, আমার সেই ঈদের আনন্দ…