শৈশবের আকাশে জ্বলজ্বল করা স্মৃতির তারা এখনো মাঝে মাঝে হৃদয়ের আঙিনায় ঝলমল করে ওঠে। আর সেই স্মৃতির মাঝে এক বিশেষ উজ্জ্বল রূপে জেগে থাকে আমার প্রথম রোজার দিন। তখন বয়স খুব বেশি নয়, হয়তো সাত কিংবা আট বছর। রমজান মাস এলেই বাড়ির পরিবেশ যেন বদলে যেত। সেহরির সময় মা, দিদি , বাবা সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। ঘুম জড়ানো চোখে আমরাও মাঝেমধ্যে উঠে পড়তাম। পুরো রোজা রাখা তখনো আমাদের জন্য কঠিন ছিল, তাই মা বলতেন, “কাধে রোজা” বা “বদনা রোজা” রাখতে পারো—মানে দুপুর পর্যন্ত রোজা! তবে সেদিন আমি ঠিক করেছিলাম, আর নয় অর্ধেক রোজা, এবার আমি পুরো রোজা রাখব।
সকালটা কেটে গেল বেশ স্বাভাবিকভাবেই। তবে দুপুরের পর থেকেই কষ্টটা বোঝা শুরু হলো—গলা শুকিয়ে কাঠ, শরীর ক্লান্ত, এমনকি খেলতেও ইচ্ছে করছিল না। বড়রা বলতেন, “রোজার শেষে ইফতারের আনন্দই আলাদা!” এই আশাতেই নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মনে হলো, আর পারছি না। বাবা তখন আমাদের গ্রামের হাটে তার হোমিওপ্যাথির চেম্বারে ছিলেন। রোজা রেখে আমিও বাবার সঙ্গে চেম্বারে গিয়েছিলাম, কিন্তু ক্লান্তিতে হাঁটাচলা করাই দায় হয়ে উঠল। রোগীদের জন্য রাখা বেঞ্চে শুয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছিল, ইফতারের সময় যেন আর আসতেই চায় না!
শেষ পর্যন্ত, ইফতারের মাত্র চল্লিশ মিনিট আগে হাল ছেড়ে দিলাম। এতক্ষণ ধরে লড়াই করার পরও পারলাম না পুরো রোজাটা রাখতে! ভেতরে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ জন্ম নিলো। তবে বাবা-মা কেউ বকেননি, বরং সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, “এটাই তো প্রথম চেষ্টা, একদিন ঠিক পারবে!”
এরপর কয়েকদিন মন খারাপ করে কাটালেও, নতুন উদ্দীপনায় আবার চেষ্টা করলাম। মাকে বললাম, “আগামীকাল সেহরির সময় আমাকে উঠাবেই!” কিন্তু মা সেদিন ডেকেছিলেন কি না, জানি না—আমি হয়তো গভীর ঘুমে ছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন বুঝতে পারলাম, রোজা রাখতে পারিনি, তখন কান্নায় ভেঙে পড়লাম। মা তখন সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আচ্ছা, ঠিক আছে, আজ জেগে থেকো, আগামীকাল ঠিক ডাকবো।”
পরদিন সত্যিই মা ডেকে দিলেন। ঘুম থেকে উঠে রোজা রাখলাম, আর এইবার পূর্ণ করলাম!
রমজানের আরেকটি অনন্য সৌন্দর্য ছিল তারাবীহ নামাজ। আমাদের বাড়িতে থাকতেন একজন মুন্সী তার সঙ্গে প্রথমবার মসজিদে যাওয়ার অনুভূতি আজও মনে আছে। সারি সারি মানুষ, ইমামের সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত, আর দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার ধৈর্য—সব মিলিয়ে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ছোট ছিলাম বলে এত দীর্ঘ নামাজ পড়তে কষ্ট হতো, কিন্তু ভেতরে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করত।
এরপর এলো ঈদের দিন—শৈশবের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্তগুলোর একটি! নতুন জামা, আতরের সুবাস, মিষ্টি খাবারের সাজানো টেবিল—সব মিলিয়ে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। সেদিন সকালবেলা সেমাই-পায়েস খেয়ে, নতুন জামা পরে বাবা-মার সঙ্গে ঈদের নামাজে গেলাম। চারপাশের খুশির আবহ, বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি, বড়দের সালাম করে ঈদি সহ হাজারো মধুর মুহূর্ত এখনো স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে আছে।
আজ বুঝতে পারি, সেই ছোটবেলার প্রথম রোজা শুধুই একদিন না খেয়ে থাকার গল্প ছিল না, বরং তা ছিল ধৈর্য, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির এক প্রশিক্ষণ। বড় হতে হতে বুঝেছি, রোজার মাহাত্ম্য শুধু ইফতারি বা ঈদের আনন্দে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আমাদের সহনশীলতা শেখায়, আত্মার পরিশুদ্ধির শিক্ষা দেয়।
এখনো যখন রমজান আসে, শৈশবের সেই প্রথম রোজার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয়, তখনকার সরলতা, পরিবারভিত্তিক উষ্ণতা আর ভালোবাসায় মোড়া সেই মুহূর্তগুলোই ছিল সত্যিকারের আনন্দের, যা আর কোনো কিছু দিয়েই বদলানো সম্ভব নয়।