ভূমিকা: অস্তিত্বের সংকট ও নেতৃত্বের দায়িত্ব:
পশ্চিম বাংলার মুসলমান সমাজ আজ এক গভীর সংকটের সম্মুখীন। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার পাশাপাশি নেতৃত্বের দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। একদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘বিপ্লবী’ সেজে ওঠা স্বঘোষিত নেতারা কার্যকর কোনো পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ; অন্যদিকে, রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। এই বাস্তবতার আলোকে, এ সমাজ কি কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট ব্যাংক হয়েই থাকবে, নাকি তারা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য সংগঠিত হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের দার্শনিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে।
গ্রিক দার্শনিক আলবেয়ার কামু তার অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেছিলেন, “সংগ্রামই জীবনকে মহিমান্বিত করে, শুধু বিজয় নয়।” কিন্তু যদি সংগ্রামই উদ্দেশ্যহীন হয়ে যায়, তবে তা এক অর্থহীন চক্রের মধ্যে পড়ে। পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের আজ এই অর্থহীনতার সীমানা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কামুর “সিসিফাসের শাস্তি”র মতো তারা যদি বারবার একই ভুল করে, তবে ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হবে।
নেতৃত্ব সংকট:
প্রাচীন দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, “একজন প্রকৃত নেতা তিনটি গুণাবলি ধারণ করেন: প্রজ্ঞা, সততা ও কর্মক্ষমতা।” কিন্তু পশ্চিম বাংলার বর্তমান মুসলিম নেতৃত্বের বেশিরভাগই এই মানদণ্ডে ব্যর্থ। সোশ্যাল মিডিয়ার বিপ্লবীরা নিজেদের ব্র্যান্ড গড়তে ব্যস্ত, বাস্তব রাজনীতিতে তাদের কোনো উপস্থিতি নেই। তারা কেবল লাইক, কমেন্ট ও ফলোয়ারের সংখ্যা বাড়ানোর দিকেই মনোযোগী, জনগণের প্রকৃত সমস্যার দিকে নয়। এই প্রবণতা মুসলিম সমাজকে আরও বিভ্রান্ত করছে এবং নেতৃত্ব সংকটকে গভীরতর করছে। সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থানের ফলে অনেকেই মনে করছেন যে, পোস্ট লেখা বা ভিডিও বানানোই রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ। কিন্তু ইতিহাস বলে, প্রকৃত পরিবর্তন আসে মাঠপর্যায়ের আন্দোলন ও সাংগঠনিক শক্তির মাধ্যমে। তাই, নেতৃত্বকে কেবল ‘ডিজিটাল’ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব দায়িত্ব নিতে হবে।
রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা :
জঁ-জাক রুশো তার সামাজিক চুক্তি তত্ত্বে বলেছিলেন, “সত্যিকারের নেতৃত্ব সাধারণ ইচ্ছার (General Will) প্রকাশ, ব্যক্তিগত কামনার নয়।” অথচ আজ পশ্চিম বাংলার মুসলিম নেতৃত্বের বড় অংশ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে নিমগ্ন। তারা মুসলমানদের রাজনৈতিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন।
বিগত কয়েক বছরে দেখা গেছে, অনেক তথাকথিত মুসলিম নেতা ভোটের সময় বিভিন্ন দলের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করেন, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন এবং ভোটের বিনিময়ে সুবিধা আদায় করেন। ফলে মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে আরও বিভক্ত হয়ে পড়ছে এবং তাদের নিজস্ব স্বার্থরক্ষা দুরূহ হয়ে উঠছে। অথচ রুশোর তত্ত্ব অনুযায়ী, যদি জনগণ তাদের প্রকৃত ইচ্ছা বুঝতে না পারে এবং নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে, তবে তারা কখনোই স্বাধীন হবে না। পশ্চিম বাংলার মুসলমানদেরও নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চিহ্নিত করে, ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে সংগঠিত হতে হবে
এলিট সংগঠন :
কার্ল মার্ক্স তার শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বে বলেছিলেন, “ইতিহাস হলো শোষক ও শোষিতের লড়াই।” বর্তমান মুসলিম নেতৃত্বের একটি বড় অংশ আসলে একটি ‘এলিট ক্লাব’ গড়ে তুলেছে, যেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কেবল নিজেদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, মজলিস-এ-মুশাওয়ারত-এর মতো সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা তারই প্রমাণ। তারা বছরে দু’-একটি সভা করে নিজেদের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করে, কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের মৌলিক সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখে না। ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষা, শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অগ্রগতি, চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি—এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সাধারণ মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে আরও পিছিয়ে পড়েছে। মার্ক্সের মতে, এই অবস্থার পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন নিপীড়িতরা নিজেদের স্বার্থ বুঝবে এবং নিজেদের নেতৃত্ব নিজেরাই তৈরি করবে। পশ্চিম বাংলার মুসলমানদেরও নিজেদের সমস্যা নিয়ে নিজেরাই ভাবতে হবে এবং বাইরের কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “একটি সম্প্রদায়ের মুক্তি তার ঐক্যের মধ্যে নিহিত।” অন্যদিকে, মহাত্মা গান্ধী স্বাবলম্বনের উপর জোর দিয়েছিলেন: “স্বাধীনতা আসে স্বয়ংক্রিয় প্রচেষ্টায়।” পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের জন্য এই দুটি দর্শনই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আজকের বাস্তবতায় মুসলমানরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থনকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু নিজেদের কোনো রাজনৈতিক কণ্ঠ নেই। বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে মুসলিম নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে পড়েছে, যার ফলে মুসলমানদের প্রকৃত সমস্যাগুলো অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। একমাত্র সমাধান হলো, মুসলমানদের নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করা কিংবা বৃহত জন আন্দোলন গড়ে তোলা। নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
ভবিষ্যৎ দিশা:
পাওলো ফ্রেয়ার তার ‘পেডাগজি অব দি অপ্রেস্ট’-এ বলেছিলেন, “নিপীড়িতদের মুক্তি আসে সমালোচনামূলক চেতনার মাধ্যমে।” মুসলমানদেরও এই চেতনা জাগ্রত করতে হবে। নেতৃত্বের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা চিহ্নিত করতে হবে। জনগণকে প্রশ্ন করতে হবে—কেন আমাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা নিরব? কেন ওবিসি সার্টিফিকেট ইস্যুতে নেতৃত্ব কোনো স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে না? কেন মুসলিম ছাত্ররা শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে? ফ্রেয়ারের মতে, যদি জনগণ প্রশ্ন করতে শেখে, তবে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের এখন এই শিক্ষার প্রয়োজন।
পরিশেষে বলা যায়, নেতৃত্ব সংকটের অবসান ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের জন্য এখন সময়ের দাবি। নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য চেতনার সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সেটা দল বা রাজনৈতিক চেতনা সম্পূর্ণ সামাজিক সংগঠন। কামুর ভাষায়, “আমাদের অবশ্যই সিসিফাসকে সুখী মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে।” কারণ, সংগ্রামই তাদের অস্তিত্বের অর্থ। যদি নেতৃত্বের সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়, যদি রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের প্রত্যাখ্যান করা হয়, যদি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করা যায়—তবে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে।ইমমানুয়েল কান্ট বলেছিলেন, “জ্ঞানবান হওয়ার সাহস করো।” পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের এখন সেই সাহস দেখানোর সময় এসেছে। জ্ঞান বিস্তারের জন্য চাই শিক্ষায় বিপ্লব।