সেলিম রেজা
রমজান আসলেই ছোটবেলার রোজার দিনগুলো মনে পড়ে যায়। সেইসব দিন, যখন রোজার অর্থ ছিলো সারাদিন উপোস থেকে মাগরিবের আজানের অপেক্ষা করা, আর ইফতারের সময় বাড়ির সবাই মিলে উৎসবের মতো খাওয়া-দাওয়া করা। কিন্তু ছোটবেলার রোজা মানেই শুধু ধর্মীয় অনুশাসন নয়, এর সঙ্গে মিশে থাকে কিছু মজার এবং কিছু কঠিন অভিজ্ঞতাও।
প্রথম রোজার স্মৃতি একেকজনের কাছে একেক রকম, কিন্তু সবার মধ্যেই একটা সাধারণ মিল—তাতে থাকে কৌতূহল, আনন্দ, আর মাঝেমধ্যে খানিকটা বিভ্রান্তিও!
আমার প্রথম রোজার কথা মনে পড়লে হাসি পেয়ে যায়। তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, বয়স সাত-আট বছর হবে। সারাদিন খেলতে খেলতে কখন যে বিকেল হয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ দেখি, আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। এমন সময় মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো! “এই তো ইফতারের সময়!”—এই ভেবে প্রাণপণে দৌড় দিলাম বাড়ির দিকে। কিন্তু বাড়িতে এসে দেখি, কেউ কোনো ইফতারের আয়োজন করেনি, মা-বাবা নির্বিকার!
আমি হতভম্ব হয়ে মা-কে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন ইফতার দাওনি?” মা হেসে বললেন, “বাবা, এটা মাগরিবের আজান না, আসরের আজান!”
আহা, তখন মুখ শুকিয়ে আরো শুকনো হয়ে গেল! ইফতার তো দূরের কথা, এখনো মাগরিবের আজানের অনেক দেরি। সেদিন বুঝেছিলাম, শুধু মেঘলা আকাশ দেখেই আজানের সময় ঠিক করা যায় না!
ক্লাস এইট থেকেই পুরো রোজা রাখা শুরু করলাম। এরপর একবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় রোজা পড়েছিলো গরমের দিনে। পরীক্ষার হলে বসে থাকার কষ্ট তো আছেই, তার ওপর দুটো পরীক্ষা একদিনে! সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত পরীক্ষা হলে বসে থাকতে হতো। সবাই মাঝে মাঝে পানি খেতো, কেউ কেউ ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খেতো, আর আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম।
দুপুর একটার বিরতিতে সবাই যখন খাবার নিয়ে ব্যস্ত, আমি তখন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে ফিরে আসতাম। কখনো শুকনো খাবার খেয়ে, কখনো বা সেহরির বাকি খাবার গরম করে খেয়ে রোজার মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করতাম। কারণ, বাড়ি থেকে আসার সময় বাবা বলে দিয়েছিলেন, “যত কষ্ট হোক, রোজা ভাঙবে না!”
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ছুটি পেলাম, আর তখনই ভাবলাম, এবার একটা অন্যরকম কিছু করা যাক। বাবার কাছে জানতে চাইলাম ইতিকাফ সম্পর্কে। বাবা বললেন, আমাদের গ্রামে কেউ কখনো ইতিকাফ করেনি। আমি মনে মনে ভাবলাম, “ছক্কা হাঁকানোর দারুণ সুযোগ!”
মায়ের কাছে দরখাস্ত পেশ করলাম, মা তো খুশি! মসজিদের এক কোণে মশারি টাঙিয়ে, তার ওপর কাপড় চাপিয়ে আমার দশ দিনের ঘর তৈরি হলো। সেই সময় ইসলামী সাহিত্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না, শুধু ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি বাংলা অনুবাদ কুরআন এবং “আহলে হাদিস” পত্রিকা।
ইতিকাফের সময় গ্রামের মানুষ আমাকে এত সম্মান দিতে লাগলো যে, আমি নিজেই অবাক! কেউ গোসলের পানি এগিয়ে দিচ্ছে, কেউ ইফতারের জন্য ভালো ভালো খাবার পাঠাচ্ছে। তবে ভয়ও দেখাচ্ছিল কেউ কেউ—মসজিদের পাশের কুয়ার দিকে ইশারা করে বলছিল, “দেখিস, রাতে ওখানে কিছু যেন না দেখে ফেলিস!”
কিন্তু আমি সাহস করে ইতিকাফ চালিয়ে গেলাম। পরে আমার মা ও বোনও ইতিকাফ করা শুরু করলেন। এ যেন এক নতুন পথের দিশা।
রমজান শুধু উপোস থাকার নাম নয়, এটি ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মশুদ্ধির এক অনন্য সুযোগ। ছোটবেলার সেই বিভ্রান্তির মুহূর্ত, পরীক্ষার হলে কষ্ট সহ্য করা, আর ইতিকাফের অভিজ্ঞতা—সব মিলিয়ে রমজান আমার জীবনে শুধু ইবাদতের নয়, শিখনীয় অধ্যায় হয়ে আছে।
আল্লাহ যেন আমাদের সুস্থ শরীরে বাকি রোজাগুলো রাখার তৌফিক দেন, আমাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করেন এবং এবারের রোজাকে জান্নাতের মাধ্যম বানিয়ে দেন। আমিন!