এম. আমিনুল আম্বিয়া
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের ডালি সাজিয়ে এক বছর পরে আমাদের কাছে আবার ফিরে এসেছে মাহে রমজান, অর্থাৎ রোজার মাস। বিশ্বের মুসলিমরা সারা বছর এই মাসের আগমনের অপেক্ষায় থাকে। এই মাসের আগমনে মুমিন হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এক মাস সারাদিন উপোস থেকেও মুমিন মুসলমান কষ্টের বদলে আরো বেশি আনন্দ লাভ করে। সারাদিন না খেয়ে থাকার মধ্যেও যে কত আনন্দ, সেটা যারা রোজা রাখেনা তাদেরকে কখনো বোঝানো যাবে না! ইন্টারনেটের এই যুগে আমরা ঘরে বসে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র রোজাদারদের সে আনন্দের চিত্র দেখতে পাচ্ছি। সারাদিন উপোস থেকে সূর্য ডোবার অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলি ইফতারের মুহূর্তে যে আনন্দ লাভ করে সে আনন্দকে পৃথিবীর কোন আনন্দের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না! বিশ্বনবী এজন্যেই বলেছিলেন, ‘রোজাদারদের জন্য দুটি খুশি, একটি ইফতারের খুশি এবং অন্যটি বিশ্ব প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের খুশি।’
না খেয়ে রোজা রাখার আনন্দ শুধু বড় রা ই উপভোগ করে না মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে, শিশু কিশোররা এই আনন্দ আরও বেশি করে উপভোগ করে। যে শিশু কিশোরদের প্রতি আল্লাহ তাআলা রোজার বিধান ফরজ করে দেননি তারাও রমজানের রোজা রাখার ক্ষেত্রে বড়দের সঙ্গে সমানে পাল্লা দেয়! তারা এতে এত আনন্দ এবং শান্তি পায় যে তাদের অভিভাবকরা রোজা রাখতে নিষেধ করলেও অভিভাবকদের শাসন উপেক্ষা করে তারা মনের আনন্দে রোজা রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করে। মসজিদে মসজিদে সন্ধ্যার আগে যখন ইফতারের আয়োজন হয়, তখন এই শিশু কিশোররা সারাদিন না খেয়ে থাকার সম্পূর্ণ কষ্ট ভুলে গিয়ে ইফতারির আনন্দে মশগুল হয়ে ওঠে। ছোটবেলায় এমনিভাবে আমরা ও ইফতারের সময় আনন্দে মেতে উঠতাম।
আমি অনেক ছোটবেলা থেকেই রোজা রাখায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু ঠিক কোন দিন প্রথম রোজা রেখেছিলাম সেটা এখন মনে করতে পারছি না। যখন অনেক ছোট ছিলাম তখন থেকে রোজা রাখার জন্য বাড়িতে জিদ ধরতাম, রাতে সাহরির সময় যেন আমাকে ডাকা হয় সে জন্যে আব্বা এবং আম্মাকে বলে রাখতাম, কিন্তু ছোট ছিলাম বলে তাঁরা রাত্রে আমাকে সাহারি খাওয়ার জন্য ডাকতেন না।
একদিনকার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, রাত্রে আমাকে সাহারি খাওয়ার জন্য ডাকা হয়নি, অথচ আমি সেদিন রোজা রাখবো কঠিন সংকল্প করেছি, সকালে উঠে খেতে হবে বলে ঘুম ভাঙার পরেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি, কিছু না খেয়ে বাগানে, এবং মাঠে মাঠে সেদিন দুপুর পর্যন্ত ঘুরে ছিলাম। আমাকে খাওয়ানোর জন্য বাগান থেকে ধরে আনার চেষ্টা হল, অথচ দুপুর পর্যন্ত আমাকে কেউ বাড়িতে আনতে পারেনি, প্রচন্ড জিদ নিয়ে সেদিন রোজা রেখেছিলাম। এরপর থেকে রাত্রে ডেকে দিতে বললে তাঁরা আর অন্যথা করতেন না। সেই শিশুকাল থেকে আজ পর্যন্ত আলহামদুলিল্লাহ এভাবেই রোজা রেখে চলেছি।
আমাদের গ্রামের নাম রায়কোলা, উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা থানার অন্তর্গত বেশ পরিচিত একটি গ্রাম। আমাদের গ্রামে, আমাদের বাড়ির পাশেই রয়েছে মুঘল যুগে তৈরি একটি সাত গম্বুজ বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মসজিদ। এই মসজিদের খোলা চত্বরে বসে আমাদের পাড়ার সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার করতাম। এখনকার মত তখন এক একদিন পালা করে একেক জন মসজিদের সব রোজাদারদের ইফতারের দায়িত্ব নিত না। প্রত্যেকে বাড়ি থেকে নিজের নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ইফতারি নিয়ে আসতো, আমরা যারা একসঙ্গে ইফতার করতাম তারা একে অপরের সঙ্গে ইফতারি ভাগ করে নিতাম। তখনকার দিনে ইফতারে এত রকমের আইটেম ছিল না। এখনকার দিনের ইফতারিতে যেসব আইটেম প্রায় দেখাই যায় না, যেমন ছাতু, খই, চিড়া, সেসব আইটেম আমাদের ইফতারিতে যথেষ্ট পরিমাণে থাকতো। প্রতিবছর রোজার মাস আসার আগে মাকে দেখতাম খই ভাজতে এবং ছাতু তৈরি করতে। এখনকার মত আরবের খেজুর তখন এদেশে পাওয়া যেত না, ফলে দেশীয় খেজুর দিয়েই সাধারণত রোজা খোলা হোত। তবে কাঁচা ছোলার সঙ্গে আদা কুচি অবশ্যই থাকতো, আর থাকতো ছোলা ভাজা।
রমজান মাসের বিশেষ নামাজ তারাবির নামাজ। এখন প্রায় প্রতিটি মসজিদে খতম তারাবির প্রচলন শুরু হয়েছে, কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় গ্রামের মসজিদগুলিতে খতম তারাবির প্রচলন ছিল না বললেই চলে। গ্রামের মসজিদে সূরা তারাবি পড়া হত। মনে আছে আমার আব্বা তারাবির নামাজে গোটা সূরা রহমান পড়তেন, সেটা বেশ ভালো লাগতো। মসজিদে তখন বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল না, ফলে তারাবি নামাজের সময় হ্যাজাক লাইট জ্বালানো হত। অন্ধকার গ্রামের ভিতরে মসজিদে যখন হ্যাজাক লাইট জ্বলে উঠতো তখন আমরা খুবই আনন্দ পেতাম। এখন সে লাইট আর চোখেও পড়ে না! মসজিদে সূরা তারাবি পড়ার মাধ্যমে আমরা আস্তে আস্তে খতম তারাবি পড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। হাফেজ সাহেব গন যখন সুরেলা কন্ঠে তারাবি নামাজের ভিতরে কোরআন তেলাওয়াত করেন তখন কুড়ি রাকাত তারাবি নামাজ কখন শেষ হয়ে যায় সেটা বুঝতেও পারি না। এটা কুরআনের একটি মোজেযা।
বাংলাদেশে আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছেন, যে কারণে ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশে আমার যাতায়াত রয়েছে। ছোটবেলায় একবার আব্বার সঙ্গে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। যশোরের কোন এক জায়গায় তখন আমার ছোট চাচা থাকতেন, সেখানে গিয়ে আমি প্রথম খতম তারাবি পড়েছিলাম। আমাদের গ্রামের মসজিদে তারাবির নামাজে তখন অতো ভিড় হতো না, কিন্তু বাংলাদেশের ঐ মসজিদে তারাবি নামাজের জামাতের ভিড় দেখে মন ভরে যেত। দুজন হাফেজ সাহেব তারাবি পড়াতেন ১০ রাকাত করে। তখন থেকেই রমজান মাসের তারাবির স্বাদ অনুভব করছি আলহামদুলিল্লাহ।
রমজান মাস কুরআন নাযিলের মাস, এই মাসেই পৃথিবীতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি রমজান মাসে রোজাদারদের মধ্যে কোরআন তেলাওয়াতের আগ্রহ বেড়ে যায়। সারা বছর যারা তেলাওয়াত করার সুযোগ পান না, তারা এই মাসে কম বেশি তেলাওয়াত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমরা কুরআন তেলাওয়াত করতে যতটা আগ্রহী, কোরআন বুঝে পড়তে ততটা আগ্রহী নই। রমজান মাসে কুরআন তেলাওয়াতের সঙ্গে সঙ্গে যদি আমরা অন্তত দশটি করে আয়াত বুঝে পড়ার চেষ্টা করি, তাহলে কোরআন যে উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে তার কিছুটা আমরা অনুভব করতে পারব বলে আশা রাখি। ছোটবেলায় আমরা কোরআন বোঝার কোন চেষ্টা করিনি, কিন্তু এখন সময় এসেছে আমাদের বাচ্চাদেরকে কোরআন বুঝিয়ে দেওয়ার। কোরআনের জ্ঞান যদি মানুষের ভিতরে না থাকে তাহলে সেই মানুষ কখনো পূর্ণ জ্ঞানি হয়ে উঠতে পারে না। ছোটবেলার সেই রোজার দিনগুলি আর কখনো আমাদের কাছে ফিরে আসবে না, কিন্তু রমজান মাস প্রতি বছরই আমাদের ফিরে কাছে আসবে। প্রতিবছর রমজানে যদি আমরা কিছুটা কোরআনের চর্চা করতে পারি তাহলে ছোটবেলার কোরান চর্চার ঘাটতি কিছুটা পূরণ করতে পারব বলে আশা করা যায়। এই মাসে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে বেশী বেশী করে কোরআন বোঝার এবং আমল করার তৌফিক দান করুন, আমীন।