প্রসেনজিৎ বসু,টিডিএন বাংলা:
মোদী সরকার এবং বিজেপি আবারো ভারতকে বিশ্বের “দ্রুততম বৃদ্ধিমান অর্থনীতি” হওয়ার বিভ্রান্তিকর দাবি করতে শুরু করেছে। CSO দ্বারা সদ্য প্রকাশিত (২৮ ফেব্রুয়ারি) GDP-র হিসেবের উপর ভিত্তি করে এই প্রচার নতুন করে শুরু হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে GDP বৃদ্ধির হার পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭-১৮) ৬.৫% থেকে বেড়ে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৭-১৮) ৭.১% হয়েছে। এই ত্রৈমাসিক ভিত্তিক GDP বৃদ্ধির হার দেখে দয়া করে বিভ্রান্ত হবে না কারণ এর থেকে অর্থনীতির মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদী স্বাস্থ্যের প্রকৃত ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।
প্রথমত, সদ্য প্রকাশিত CSO-র GDP হিসেব এটাও দেখাচ্ছে যে ২০১৭-১৮’র পুরো বছরের বার্ষিক GDP বৃদ্ধির হার হবে ৬.৬%, যা আসলে ২০১৬-১৭’র ৭.১% থেকে কম। বাজেটের আগে প্রকাশিত ২০১৮’র অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বার্ষিক GDP বৃদ্ধির হার ২০১৭-১৮’তে ৬.৭৫% হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। সেই অনুমানের থেকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির আসল হার কমই হবে বলে CSO জানিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, CSO-র এই সদ্য প্রকাশিত তথ্যের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তিকর উপাদান আছে। CSO প্রকাশিত ২০১৭-১৮-র প্রথম আগাম অনুমান অনুসারে (First Advanced Estimates যেটা ২০১৮-র জানুয়ারিতে প্রকাশ করা হয়েছিল), ২০১৭-১৮ তে কৃষি GVA বৃদ্ধির হার ২.১% দেখানো হয়েছিল। সদ্য প্রকাশিত দ্বিতীয় আগাম অনুমান (Second Advanced Estimates) অনুসারে ২০১৭-১৮-র কৃষি GVA বৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে ৩%। চলতি অর্থবছরেই পর পর দুটি অনুমানে কৃষি উৎপাদনের সূচক এতটা বদলে যাবার কারণ কি? জানুয়ারিতে CSO বলেছিল ২০১৭-১৮-র Q1 এবং Q2তে (প্রথম ও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে) কৃষি GVA বৃদ্ধির হার হয়েছে ২.৩% এবং ১.৭%। অথচ সদ্য প্রকাশিত তথ্যে CSO বলছে ২০১৭-১৮-র Q1, Q2 এবং Q3’তে কৃষি GVA বৃদ্ধির হার ২.৭%, ২.৭% এবং ৪.১%। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে হঠাৎ এতটা বৃদ্ধি এল কিভাবে? পুরনো ত্রৈমাসিকের কৃষি উৎপাদনের আগের হিসেবও অনেকটাই বদলে গেল কিভাবে?
তৃতীয়ত, CSO-র এই দ্বিতীয় অনুমানে গত দুই ত্রৈমাসিকে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর কিছুটা সামলে উঠেছে বলে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এখানেও, অনুমানের বিভিন্ন সূচক গুলি বিভ্রান্তিকর। জানুয়ারি তে প্রকাশিত CSO-র প্রথম আগাম অনুমানে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে ২০১৭-১৮’তে Q1 এবং Q2’র GVA বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১.২% এবং ৭% দেখানো হয়েছিল। নতুন আগাম অনুমান অনুযায়ী ম্যানুফ্যাকচারিং উৎপাদন বৃদ্ধি ২০১৭-১৮’র Q1, Q2 এবং Q3তে (-) ১.৮%, ৬.৯% এবং ৮.১% দেখানো হয়েছে। তাহলে কি এই আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ম্যানুফ্যাকচারিং উৎপাদন বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়ে গিয়েছিল, যা আগে প্রকাশ করা হয়নি? সামগ্রিকভাবে, ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে GVA বৃদ্ধির হার ২০১৬-১৭ সালে ৭.৯% থেকে ২০১৭-১৮ সালে ৫%’তে নেমে আসবে বলে
দেখানো হয়েছে।
চতুর্থত, CSO-র প্রকাশিত প্রথম এবং দ্বিতীয় অনুমানের সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তিকর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফর্মেশন (GFCF)-এর তথ্যতে। GFCF/GDP অনুপাতটি অর্থনীতিতে বিনিয়োগের হার নির্দেশ করে। জানুয়ারি ২০১৮তে প্রকাশিত আগাম অনুমান অনুযায়ী তিন বছর ধরে বিনিয়োগের হার ছিল নিম্নরূপ:
GFCF/GDP (২০১১-১২ মূল্যে):
২০১৭-১৮ (প্রথম আগাম অনুমান): ২৯%
২০১৬-১৭ (অস্থায়ী অনুমান): ২৯.৫%
২০১৫-১৬: ৩০.৯%
GFCF/GDP (বর্তমান মূল্যে):
২০১৭-১৮ (প্রথম অনুমান): ২৬.৪%
২০১৬-১৭ (অস্থায়ী অনুমান): ২৭.১%
২০১৫-১৬: ২৯.৩%
২৮ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত দ্বিতীয় আগাম অনুমানে বিনিয়োগের হারের নিম্নোক্ত তথ্য প্রদান করা হয়েছে:
GFCF/GDP (২০১১-১২ মূল্যে):
২০১৭-১৮ (দ্বিতীয় আগাম অনুমান): ৩১.৪%
২০১৬-১৭ (প্রথম সংশোধিত অনুমান): ৩১.১%
২০১৫-১৬ (দ্বিতীয় সংশোধিত অনুমান): ৩০.৩%
GFCF/GDP (বর্তমান মূল্যে):
২০১৭-১৮ (দ্বিতীয় আগাম অনুমান): ২৮.৫%
২০১৬-১৭ (প্রথম সংশোধিত অনুমান): ২৮.৫%
২০১৫-১৬ (দ্বিতীয় সংশোধিত অনুমান): ২৮.৫%
জানুয়ারী ২০১৮’তে CSO-র প্রকাশিত তথ্য অনুসারে অর্থনীতিতে গত তিন বছরে আসল বিনিয়োগের হার ছিল ক্রমাগত নিম্নমুখী। এখন ফেব্রুয়ারি ২০১৮’তে দেখা যাচ্ছে যে গত তিন বছরে আসল বিনিয়োগের হার ক্রমাগত বেড়েছে। কোন জাদুগুণে এটা সম্ভব তা বোঝা দায়! জানুয়ারী ২০১৮তে CSO-র প্রকাশিত তথ্য অনুসারে বর্তমান মূল্যে বিনিয়োগের হারও ছিল নিম্নমুখী। দ্বিতীয় আগাম অনুমান দেখাচ্ছে যে GFCF/GDP অনুপাত গত তিন বছরে হুবহু একই রওয়ে গেছে। এটা কিভাবে সম্ভব?
আসলে মোদী সরকার দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। আসলে কৃষি উৎপাদন স্থবির হয়ে আছে, আর নোটবাতিল এবং জিএসটি-র মতন নীতির জন্য শিল্পে উৎপাদনে অস্থিরতা ঘটেছে। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাও বিশাল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়েছে। এই অবস্থায় সরকার আসন্ন নির্বাচনগুলির আগে অর্থনৈতিক অবস্থার এমন একটি অতিরঞ্জিত এবং আশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরতে চাইছে, যা বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যহীন। অর্থনৈতিক তথ্যগুলোকে কৌশলে পরিবর্তন করে সংবাদমাধ্যমে এমন শিরোনাম তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, যাতে অর্থনীতির পরিস্থিতির প্রতিকূলতাকে লোকানো যায়। এর জন্য CSO-র মতন একটি সংস্থাকে অপব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে তার বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
খবরে আগেই বেরিয়েছে যে এই বাজেটে সরকার ২০১৭-১৮-র জিএসটি-র রাজস্ব সংগ্রহকে ১ লক্ষ কোটি টাকা বেশী করে দেখিয়েছে। বাজেটে ঘাটতির (Fiscal Deficit) পরিমাণ এই বছরে আসলে ৩.৫%-র বেশীই হতে চলেছে। অর্থনীতির তথ্য নিয়ে বিকৃতি করেও কিন্তু সরকার পার পেয়ে যাচ্ছে কারণ মূলধারার প্রচার মাধ্যমে কেউই অর্থমন্ত্রীকে এই সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলি করছে না। এটা ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
অনুবাদঃ সুশোভন পাত্র
(লেখক ইয়ং বেঙ্গলের নেতা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ)
২ মার্চ ২০১৮