ডঃ নাজিবর রহমান
পূর্ণরূপে রমজান মাসের রোজা রেখে আমার জীবনের প্রথম ঈদের আনন্দের স্মৃতি আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। সেই দিনটি আমার জন্য সৌভাগ্যের দিন ছিল। মনে হয়েছিল যেন মন ভরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছি, যা আজও মনে পড়লে আবেগে ভেসে যাই। শৈশবে সকালবেলায় শুধু ঈদগাহে বা ঈদের মাঠে নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার নাম ঈদ ছিলনা। তবে সেই ঈদ ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। ঈদের দিনটি শুধু আনন্দময়, পারিবারিক মেলবন্ধন আর ভালোবাসার স্মৃতিতে ভরপুর। ছোট ছোট সাথী ভাই ও বোনদের একসাথে হইহুল্লোড়, ছুটেছোটি, গল্প গুজব, খাওয়ার স্বাদ এবং ভ্যারাইটিজের প্রতিযোগিতা, পোশাকের উজ্জ্বলতার প্রতিযোগিতা। এক অনন্য অভিজ্ঞতা ছিল l সেই প্রথম ঈদের আনন্দ আমার জীবনে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে রয়ে গেল, যা আজও মনের মধ্যে গভীর আবেগ সৃষ্টি করে। সেই দিন আর এই দিন বিস্তর ফারাক বিস্তার করে রয়েছে জীবনের স্মৃতির মনিকোঠায় l আজকের দিনে স্মৃতিচারণা লিখতে বসে কষ্ট হয় সেই দিনগুলো হারিয়ে যাওয়ার জন্য এবং সেই আনন্দঘন পরিবেশ আর ফিরিয়ে না পাওয়ার বেদনার জন্য l
সেই দিন রমজানের শেষে ইফতারের পরে , মাগরিবের নামাজ পড়ে, কেহ উঠল মসজিদের ছাদে, কেহ দৌড় দিল ফুটবল মাঠে, আবার কেউ কেউ বাড়ির পিছনে l সবার লেগেছে ঈদের চাঁদ দেখার হিড়িক l আমরাও ছুটে গেলাম বাড়ির পিছনে, পশ্চিম দিকে, ঈদের চাঁদ দেখার জন্য। আকাশ পরিষ্কার ছিল, একবারে সরু বা মিহি ধরনের চাঁদকে দেখতে পেলাম নিজের চোখে হৈ হৈ আনন্দে আমরা নেচে উঠলাম। আমাদের ৬-৭ জন তুতো ভাই বোন জমা হলাম আমাদের বাড়ির গলিতে। যদিও জীবনে প্রথম বারের মত রমজান মাসের সব কটা রোজা করতে পেরেছিলাম তথাপি ঈদের চাঁদ ওঠার পরে কার রোজা কেমন হলো সেই সম্পর্কে কোন আলোচনা আর ছিল না আমাদের মাঝে l আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল কে কেমন নতুন কাপড় পেয়েছে। কার জামা বেশি ভালো নিজের নিজের বড়াই সবাই পেশ করলো। আমিও পিছিয়ে থাকি নি l খয়েরি রংগের ফুলের কাজ করা, নতুন সাদা পাঞ্জাবি খোদ কলকাতা থেকে বড় দাদা নিয়ে এসেছে। তা নিশ্চয়ই সবার চাইতেই ভালো হবেই হবে, এই ছিল আমার মন্তব্য l গল্প শেষে ঘরে ফিরে দেখি সাত আট জন মানুষ আমাদের দাদুর বড় বৈঠক ঘরে বসে আলোচনা এবং লেখালেখি করছে l
সেই আলোচনায় উপস্থিত হয়েছেন আমাদের ঈদগাহের ইমাম মাওলানা নাসির উদ্দিন, উনি সম্পর্কে আমার চাচা ( বড় দাদুর বড় ছেলে )। আছেন আমাদের গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মাহাবুব আলী। আর ছিলেন এলাকার কয়জন মাওলানা। আমার দাদু, মোহাম্মদ হোসেন মোল্লা,আমার আব্বা রুস্তম আলী মোল্লা এবং বড় ভাইমাওলানা জিল্লুর রহমান বসে ছিলেন একসাথে l পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম সকাল আটটায় ঈদের নামাজ হবে আগামীকাল l তিনজন ঢলি (যারা ঢোল বাজায়) এসেছে তাদের কাগজে লিখে দেওয়া হল, আগামীকাল ঈদের ঘোষণা, তাতে সহি করলেন ঈদগাহের ইমাম l নির্দেশ দেওয়া হল দশ বারোটা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে তারা ঢোল বাজিয়ে বাজিয়ে ঈদের ঘোষণা দিয়ে আসবে l
কিছুক্ষণ পরে আমাদের ছোট বৈঠকখানায় দেখলাম মাইক এসেছে। আমাদের ঈদগাহে কয়েক হাজার মানুষ ঈদের নামাজ পড়ে, তাই মাইকের ব্যবস্থা করা হয় প্রত্যেক বছর এবং মাইকম্যান, মাইক নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতেই থাকে l সন্ধ্যাবেলায় মাইক টেস্টিং করার জন্য চালু হলো l অনেকেই হ্যালো হ্যালো করলো l ঈদগাহের ইমাম আগামী দিনের ঈদের সময়ের ঘোষণা দিলেন এবং ঈদের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কিছু নির্দেশনা জারি করলেন l ওনারা চলে যাওয়ার পরে মাইক ম্যান জিজ্ঞাসা করলো এই তোমরা কিছু বলবে নাকি ? আমার স্পষ্ট মনে আছে, মাইক ধরে একটা কবিতা আমি বলেছিলাম l সেই কবিতাটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘অঞ্জনা-নদী-তীরে চন্দনী গাঁয়ে, পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে।’ কবিতাটি সহজপাঠ বইয়ের দ্বিতীয় ভাগে থাকলেও সে সময়ে এটা আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল l মাইকের কাছ থেকে এসে আমাদের গ্রুপের ভাই-বোনেরা সবাই নিজের নিজের ঘরে চলে যায় ঘুমানোর জন্য এবং ঠিক হয় কালকে ঈদের দিন যে উঠবে আগে উঠবে সে সকলকে জাগিয়ে তুলবে এবং ফুর্তি হবে l
এরপর রমজানের এই রোজার শেষে এলো ঈদের দিন। খুশির দিন l ঈদের দিনের ভোর রাতে যথারীতি ঘুম ভেঙেছিল l একে একে আমরা ডাকাহাঁকা করে একসাথে প্রায় ৬/৭ জন চাচাতো এবং ফুফাত ভাই বোন জড়ো হয়েছিলাম। যৌথ পরিবারের মত চারদিকে ঘেরা বাড়িতে যেমন চাচারা ছিলেন আবার ঈদের সময় ছোট দুই ফুপু ঈদ করতে এসেছিলেন, আমাদের বাড়িতে। আমাদের মা, চাচিরা ব্যস্ত ছিলেন বিভিন্ন রকমের খাদ্য তৈরি করতে l কিন্তু আমাদের আবার ছিল একে অপরকে জেতার তৎপরতা l অর্থাৎ আমার মা কত সুন্দর আন্দারসা বানাতে পারে, এনামুল বলে আমার মায়ের গুড়ের ক্ষীর সবার চাইতে ভালো, তাহির বলল না না আমার মা এবারে গুড়ের ক্ষীরের সাথে দুধ দিয়েছে ওটাই সবচাইতে ভালো, সোনাভান বলল সবারই টাই ভালো, সবারই টাই ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি l সবাই সবারটা খাব , আর সবাই ফুর্তি করব, এই ছিল আমাদের সেই ভোরের উপসংহার l
ফিতরা বিতরণের আসর
এর পাশাপাশি লক্ষ্য করেছিলাম, ফজর নামাজের পরে আলো ফুটতেই, আব্বা দাদু এবং আরো কয়েকজন গ্রামীণ লোক, আমাদের আট বাংলা বড় বৈঠকখানায় বসে খাতায় লিখে লিখে গ্রামের মানুষদের মধ্যে ফিতরা বিতরণের কাজে ব্যস্ত। ফিতরা বিতরণ করার সময় বুঝতে পারলাম দানের প্রকৃত মাহাত্ম্য। আজও মনে পড়ে, ফিতরার টাকা,পয়সা পেয়ে বিধবা এবং সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের হাসিহাসিখুশি ভাব l তা সত্যিই অবর্ণনীয়।
সূর্য উঠার পর, বালটি ভরে কুয়া থেকে জল তুলে দিলেন বড় ভাবি l গোসল হলো তারপরে ঈদগাহে যাওয়ার পালা l অনেকের নতুন কাপড়, আবার পাড়া-প্রতিবেশী কারো কারো দেখলাম নতুন কাপড় নেই। আমার বড় ভাইজান কলকাতায় আলিম , ফাজিল পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিয়ে এসেছে আমাদের জন্য নতুন পাঞ্জাবি। এমব্রয়ডারি করা নতুন পাঞ্জাবি এবং পাটা পাটা কাপড়ের পায়জামা পরে ইটগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়লাম। সবার সঙ্গে কোলাকুলির প্রচলন না থাকলেও হাত ধরাধরি করে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বেড়ানোতে এক অন্যরকম আনন্দ ছিল। মিষ্টান্ন ও সুস্বাদু খাবার তো ছিলই, তবে সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল সেই উৎসবের আমেজ।